বৃহস্পতিবার, ২৩ Jun ২০২২, ০৫:৩২ পূর্বাহ্ন
আলোকধারা: মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর মাঝে কেন সৌদী আরবকে একটু বিশেষ চোখে দেখা হয়? এ দেশটির আলাদা মর্যাদা কোথায়?
মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম : এ দেশটিতেই আছে হারামাইন শরীফাইন। মক্কা মুকাররমা আর মদীনা মুনাওয়ারার মত দুটি শহর রয়েছে এখানে। হারামাইনে অবস্থানের কারণে সারা পৃথিবীর মুসিলমগণ এদেশের প্রতি শ্রদ্ধা সমীহ পোষণ করত সবসময়ই। তাতে একটা বাড়তি মাত্রা যোগ হয়েছিল মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল ওয়াহহাব নাজদীর সংস্কার আন্দোলনের কারণে। মূলত সাউদ বংশীয় যে রাজত্ব এর প্রতিষ্ঠা ও এর স্থিতিশীলতার পেছনে এ সংস্কার আন্দোলনের যথেষ্ট ভূমিকা আছে। এ কারণেই এ যাবতকাল সৌদী সরকার মুহাম্মদ ইবন আব্দুল ওয়াহহাব নাজদীর অনুসারী ওলামাকে যথেষ্ট মূল্যায়ন করত। ফলে দেশব্যাপী ইসলামের সংস্কৃতি, ইসলামী বিধানাবলী যাতে প্রতিষ্ঠা পায় এবং মানুষ তা অনুসরণ করে চলে এ ব্যাপারে এখানকার উলামায়ে কেরাম ভূমিকা রাখতে পারতেন। তারা সরকারকে পরামর্শ দিতেন, সরকারও তা গুরুত্বের সঙ্গে নিত। অন্তত বাদশা ফাহাদ পর্যন্ত এভাবে চলেছিল। এরপর ক্রমে সৌদী সরকারের কাছে উলামায়ে কেরামের মূল্যায়ন হৃাস পেতে থাকে। বর্তমানে তো হৃাস পেতে পেতে বলা যায় একেবারে শূন্যের কোঠায় চলে এসেছে। এটা সৌদী সরকারের জন্য শুভ লক্ষণ না। কারণ তারা উলামায়ে কেরামেকে অবজ্ঞা করে যেভাবে পশ্চিমা সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকছে, ইসলামবিরোধী শক্তিগুলোর সঙ্গে যেভাবে সখ্য করছে, তাতে তারা মুসলিমজাহানের বিশেষত সারা বিশ্বের মুসলিম সাধারণের শ্রদ্ধা হারাবে। তাদের ভক্তি ও সমর্থন হারাবে। ফলে অন্যান্য রাষ্ট্রের মতই এটা একটা সাধারণ রাষ্ট্র হয়ে থাকবে। এটা তাদের রাজনৈতিক ভিত্তিকেও দূর্বল করে দিতে পারে।
–রাজনৈতিক ভিত্তি বলতে….
—-তারা দেশ শাসন করছে একটা অমিত বিক্রমের সঙ্গে, তেজের সঙ্গে। যদি তারা সারা পৃথিবীর মুসলমানদের জনসমর্থন হারায় তার প্রভাব তো সৌদী জনগনের মধ্যেও পড়বে। ক্রমে সৌদীর নাগরিকগণ গণতন্ত্রমুখী হয়ে পড়তে পারে। আর গণতন্ত্রমুখী হয়ে পড়লে তাদের রাজতন্ত্র বেশিদিন ধরে রাখা সম্ভব হবে না। এক সময় গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা হয়ে যেতে পারে। তখন ঐ দেশে ইসলামী কালচারের কী অবস্থা হবে তা তো সময়ই বলবে।
আমি যে কথা এখন বলতে চাচ্ছি তা হল- সরকারের কাছে সৌদী উলামার যে ওজন ছিল, যে মূল্য ছিল, সৌদী উলামা তা দিন দিন হারাতে বসেছে। এ অবস্থায় তাদের জন্য নতুন কোন বিতর্ক জন্ম দেওয়া উচিত না। তাদের দেশের কী পরিণতি হচ্ছে তাদের সেটাই বেশি ভাবা উচিত।
–সম্প্রতি সৌদী প্রশাসন নতুন এক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। তাবলীগ জামাতের কার্যক্রমকে সে দেশজুড়ে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। তাবলীগ জামাতের ভালোমন্দ নিয়ে জানতে চাই। আসলেই কি এটাকে নিষিদ্ধ করা দরকার ছিল?
—তাবলীগ জামাত সারা বিশ্বে মানুষকে দীন ও ঈমানের দিকে ডাকছে। মানুষকে দীনমুখী, নামাজমুখী করছে। করার মেহনত করছে। সেখানে ভাসা ভাসাভাবে চিন্তা করে একটা ফতোয়া দাঁড় করিয়ে দেওয়া কিছুতেই সঙ্গত নয়। অবশ্য এ ফতোয়া দেওয়ার পেছনে তাবলীগ জামাতের কার্যক্রমেরও কিছুটা দখল আছে। তাবলীগ জামাত যারা করে, তাদের মধ্যে যারা গোঁড়াপন্থী বা যাদের মধ্যে বোঝ-বুদ্ধির অভাব তারা তাবলীগের কর্মকান্ডকে ‘সুন্নত’ মনে করে। তাদের এ দাওয়াতের পদ্ধতিকেই ‘নববী দাওয়াত’ মনে করে। নবীওয়ালা দাওয়াত বলে। নিজেদের তৈরি করা একটা পদ্ধতিকেই যদি নবীওয়ালা মেহনত বলা হয় বা এটাকেই কেবল সুন্নত বলা হয়, এর থেকে এক কদম সরাকে যদি অপরাধ মনে করা হয় বা গুনাহ মনে করা হয় তাহলে এটা বিদআত হয়ে যাবে। তাবলীগের এক শ্রেণির ‘জুহালা’ এর কর্মপন্থার কারণেই কেউ কেউ হয়তো এটাকে বিদআত মনে করছে। এটাই সৌদী উলামার সামনে উঠে এসেছে। সে কারণেই তারা হয়তো বিদআত বলছে।
নাহয় তাবলীগ জামাতের মূল যে ফিকিরটা, তাদের ছয় উসূল, এবং ছয় উসূলভিত্তিক যে মেহনত এটা আদৌ বিদআত নয়। বরং আমরা তো লক্ষ করছি, বাস্তবতাও সাক্ষী- এটা এত বেশি উপকারী হয়েছে যে বহু বছরে আওয়ামের মধ্যে অন্য কোন মেহনত এত সুফল বয়ে আনেনি। এ মেহনতের বদৌলতে নামাজীর সংখ্যা বাড়ছে। উলামার সংখ্যা বেড়েছে। মসজিদ মাদরাসার সংখ্যা বেড়েছে। মানুষের মধ্যে সুন্নতের আমলের জযবা বেড়েছে। ঘরে ঘরে অনেকগুলো সুন্নত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মানুষের ভাষায় পরিবর্তন এসেছে। জবানে অনেক দীনি ‘আলফাজ’(শব্দাবলী) চলে এসেছে। এরকম বহুবিধ উপকার তাবলীগ জামাতের বদৌলতে এসেছে। দরকার ছিল তাবলীগ জামাতের যে ত্রুটিগুলো রয়েছে এগুলো যাতে সংশোধন হয় সে ব্যাপারে মাশওয়ারা দেওয়া। তার পরিবর্তে মেহনতটাকেই একদম বাতিল সাব্যস্ত করা, বিদআত বলে দেওয়া, এটা কিছুতেই মুনাসিব না।
তবে একটা কথা ঠিক- তাবলীগ জামাতের যে নতুন একটা ফিরকা তৈরি হয়েছে, যেটাকে এতাআতপন্থী বা সাদপন্থী নামে অভিহিত করা হয়, এরা তো অনেকটা খারেজী বিদআতীদের মতোই। এরা তো বইতেও লিখেছে- কেউ এদের বাইরে চলে গেলে ‘ওয়াজিবুল ক্বতল’ হয়ে যায়। এটা তো খারেজী মতবাদের কথা হয়ে গেল। সাদ সাহেব তাবলীগের কার্যক্রমকে যেভাবে তুলে ধরছে, যে সূরতে তুলে ধরছে তাতে যে এটা বিদআতের পর্যায়ে চলে এসেছে, তা তো বলাই যেতে পারে। যারা ঐ পথের তাদেরও সতর্ক হওয়া উচিত। তাদের আত্মসমালোচনা করা উচিত। চিন্তা করা উচিত যে আসলে তারা কী করছে। ইতোমধ্যেই তো তাদের কারণে এত বড় একটা মেহনত স্থবির হয়ে গেছে। আবার এখন এ ‘বিদআতের ফতোয়া’ও যদি মানুষের মধ্যে গুরুত্ব পায় তাহলে এ কাজটা যতটুকু চলছে তাও বন্ধ হয়ে যেতে পারে ।
— ফতোয়াগুলোতে দাবি তোলা হচ্ছে- তাবলীগ জামাতের আকীদার মাঝে নানা শিরকী আকীদা আছে। এছাড়া বিভিন্ন জাল হাদীস, ‘খুরাফাত’- কেচ্ছা কাহিনী তাবলীগওয়ালারা চর্চা করে। তারা যে কিতাবগুলো পড়ে এবং পড়ার কথা বলে তাতে এসব উপাদান বিদ্যমান। এসব পড়ে পড়ে মানুষ শিরকী আকীদার দিকে যাচ্ছে। এ বিষয়ে আপনি কি একমত?
—- ঐটা তো তারা সবাইকেই বলে। এটা তো তাদের পুরনো স্বভাব। তারা তাদের দলের বাইরের সবাইকেই মুশরিক মনে করে। কিন্তু ঐটা মানুষ গ্রহণ করে নাই। ভাসা ভাসা মানসিকতার কেউ কেউ গ্রহণ করেছে। কিন্তু সাধারণভাবে মানুষ এটাকে কবুল করেনি। এসব ফতোয়ার কারণে সালাফিয়্যাতই একটা উগ্রপন্থা হিসেবে মানুষের কাছে প্রতিভাত হয়েছে। মানুষ মনে করে সালাফী পন্থাই হল উগ্রপন্থা।
–ফাজায়েলে আমাল, ফাজায়েলে হজ্জ এ সমস্ত কিতাবকে তারা শিরকী বিদআতী কিতাব হিসেবে আখ্যা দেয়।
—-দেখুন, এসব কিতাব যেহেতু ‘মুফীদ,’ জনসাধারণের জন্য অত্যন্ত উপকারী তাই দরকার ছিল এতে যে ত্রুটি-বিচ্যুতি ও কমতিগুলো আছে সেগুলো সংশোধনের চেষ্টা করা। তা না করে গোড়া থেকে উপড়ে ফেলতে হবে কেন?
— ‘চিল্লা’ ‘গাশত’ ইত্যাদি বিষয়কে অনেকে ক্ষেত্রে ‘নববী দাওয়াতের কর্মপন্থা’ হিসেবে প্রচার করা হয়। সেক্ষেত্রে এটা কি বিদআত হয়ে যায় কি না!
—-যদি এটাকে সুন্নত মনে করা হয় তাহলে বিদআত হয়েই যাবে। কেউ যদি মনে করে চিল্লা দেওয়া সুন্নত তাহলে তো এটা বিদআতই। তবে এটাকে সুন্নত তো মনে করা হয় না। নিজের ভেতর কাজের উদ্যম সৃষ্টির জন্য চল্লিশ দিনের সফর এটা সহায়ক। এজন্যই যদি এটাকে জরুরি মনে করে তখন তো এটা বিদআতের মধ্যে পড়বে না।
–যারা এ কর্মপন্থাগুলো নির্ধারণ করেছেন, তারা তো এটাকে সুন্নত মনে করেননি।
—- এখনো যারা মুরুব্বি, তারা এটাকে সুন্নত মনে করে বলেন না। তারা বলেন ঐজন্য যে, চল্লিশ দিনে কাজটা ভালোভাবে শেখা যায় আর নিজের মধ্যেও আগ্রহ তৈরি হয়। ফলে সে এ কাজ নিয়ে সামনে বাড়বে। ‘এটা সুন্নত তরীকা,’ ‘না করলে সুন্নত লঙ্ঘন হবে’ এরকম তারা বলেন না। যদি কেউ বলে তাহলে সে এটাকে বিদআতের পর্যায়ে নিয়ে যাবে।
— আরেকটি প্রশ্ন- তাবলীগের মেহনত যারা করেন তাদেরকে দেখা যায়- তাবলীগের নির্দিষ্ট গন্ডির ভেতরই তারা নিজেকে আটকে রাখেন। অন্য কোনে মেহনতের সাথে যুক্ত হন না। এমনকি বহুদিন মেহনত করার পর সহীহ শুদ্ধভাবে কুরআনুল কারীম তিলাওয়াত করতেও পারেন না। সেদিকে তাদের মনোযোগটা কম থাকে।
—- এ ব্যাপারটা ইলইয়াস রহ. এর কর্মপন্থা থেকে তাদের সরে আসার কারণে হয়েছে। ইলইয়াস রহ. এ মেহনতটা চালু করেছেন এজন্য যে, এর দ্বারা তাদের মধ্যে উদ্যম সৃষ্টি হবে ফলে দীনের বাকি বিষয়গুলোতেও তারা এগিয়ে যাবে। উনি এটা চালু করেছেনই দীনের পিপাসা সৃষ্টির জন্য। ঐজন্যই তো বলা হয় ‘ফাজায়েল শেখা হবে তালীমের হালকায়, আর মাসায়ের উলামার কাছে গিয়ে গিয়ে।’ যাতে উলামার কাছে যাওয়া হয়। উনার মালফুযাতের এক জায়গায় আছে এমন- ‘এখানে যেটুকু মশক করা হচ্ছে তা যথেষ্ট নয়, আলাদা সময় নিয়ে তারা যেন কুরআনুল কারীম শিখে নেন।’ এমন বলেছেন তিনি। ইলইয়াস রহ. এর হেদায়াতগুলো এরা পরিপূর্ণ অনুসরণ করছে না।
— তাবলীগের প্রচলিত এ কর্মপন্থায় সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করেন?
—-সংস্কার দরকার। মানে মূলধারায় ফিরে আসা দরকার। ইলইয়াস রহ. এর কাঠামোতে ফিরে আসা দরকার। সেখান থেকে তারা সরে গেছে।
–অনেক শুকরিয়া। জাযাকাল্লাহ।
—-ওয়া ইয়্যাকুম….
Leave a Reply